Saturday 25 April 2015

ইসরা ও মিরাজ : সংক্ষিপ্ত কাহিনী : ফলাফল

ইসরা ও মিরাজের সংক্ষিপ্ত কাহিনী
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা শরীফের হিজ্‌র বা হাতীমে শোয়া ছিলেন। তার সাথে আরও দু’জন শোয়া ছিলেন। কোন কোন বর্ণনায় তাদের নাম এসেছে, হামযাহ ও জা‘ফর। এমতাবস্থায় তিন ফেরেশতা এসে বললেন, এদের মধ্যে কোনটি সে লোক? একজন বলল, মাঝখানে যিনি শুয়ে আছেন তিনি। তারপর তারা চলে গেলেন।
পরবর্তী দিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের সালাত আদায় করে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় ঘরের ছাদ ভেদ করে ফেরেশতাগণ অবতরণ করলেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যমযমের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর তার “সাক্কুস সাদর” বা বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। তারপর তাকে যমযমের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে লাগিয়ে দিয়ে বক্ষ মিলিয়ে দিলেন।
এরপর বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে আকাশের দিকে যাত্রা করা হয়। সেখানে প্রথম আকাশে আদম, দ্বিতীয় আকাশে ঈসা ও ইয়াহইয়া, তৃতীয় আকাশে ইউসুফ, চতুর্থ আকাশে ইদরীস, পঞ্চম আকাশে হারূন, ষষ্ট আকাশে মূসা এবং সপ্তম আকাশে ইবরাহীম আলাইহিমুস সালাম এর সাথে সাক্ষাত করেন। সেখানে তিনি বাইতুল মা‘মুর দেখতে পেলেন। সেখানে তাকে দুধ, মধু ও মদ এ তিনপ্রকার পানীয় দেয়া হয়। তিনি দুধ পছন্দ করে নেন। তখন জিবরীল বললেন যে, আপনি স্বাভাবিক বিষয় গ্রহণ করতে সমর্থ হলেন। তারপর তিনি সিদরাতুল মুন্তাহায় নীত হলেন। তারপর এত উচুতে গেলেন যে, কলমের লিখার খসখস আওয়াজ শুনতে পেলেন। এরপর আল্লাহ্ তার ও তার উম্মতের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করে দিলেন। এরপর মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে আসার পর তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাতের ব্যাপারে আল্লাহ্‌র কাছে কমানোর আবেদন করার পরামর্শ দিলেন। প্রথমে অর্ধেক, তারপর পাঁচ ওয়াক্ত পর্যন্ত কমানো হয়। অপর বর্ণনায়, প্রতিবারে পাঁচ, বর্ণনান্তরে দশ করে কমানোর পর সবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে এসে তা শেষ হয়। এরপর তিনি দুনিয়াতে ফেরত আসেন।
অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, সফরের শুরুতে বোরাক নিয়ে আসা হয়। ‘বোরাক’ বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে সফর করে। সেখানে তিনি নবীদের ইমামতি করেন। তারপর তাকে সেখানে তাকে দুধ মধু ও মদ এ তিনপ্রকার পানীয় দেয়া হয়। তিনি দুধ পছন্দ করে নেন। তখন জিবরীল বললেন যে, আপনি স্বাভাবিক বিষয় গ্রহণ করতে সমর্থ হলেন। তারপর তার জন্য মি‘রাজ বা সিড়ি নামিয়ে দেয়া হলে তিনি তাতে করে আকাশে গমন করলেন।…
ইসরা ও মিরাজের ফলাফল:
১- ইসরা ও মি‘রাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ তার রাসূলকে বান্দা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এটি সৃষ্টিজগতের কারও জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। মহান আল্লাহ্ বলেন,
﴿سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِۦ لَيۡلٗا مِّنَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ إِلَى ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡأَقۡصَا ٱلَّذِي بَٰرَكۡنَا حَوۡلَهُۥ لِنُرِيَهُۥ مِنۡ ءَايَٰتِنَآۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١﴾ [سورة بني إسرائيل: 1]
২- ইসরা ও মি‘রাজের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, নবীগণ সবাই বৈমাত্রেয় ভাই। তাদের মিশন একটিই সেটি হলো, একমাত্র আল্লাহ্‌র ইবাদত প্রতিষ্ঠা করা।
৩- রাতের একটি অংশে ইসরা ও মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার মধ্যে এটাই উদ্দেশ্য যে, মহান আল্লাহ্র কাছে রাতের কাজই বেশী পছন্দ। কারণ তখন প্রকৃতি শান্ত থাকে। কাজে মন বসে। ইবাদতে একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা অর্জিত হয়।
৪- সূরা আল-ইসরার প্রথমে سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَىٰ বলার পরে নবম আয়াতে কুরআনের মাধ্যমে কারা হিদায়াত প্রাপ্ত হবে তাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। এ দুয়ের মাঝখানে ইয়াহূদীদের উপর আপতিত শাস্তি ও তাদের জাতীয় চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, ইয়াহূদী ও নাসারাদের দীনের দাবী শেষ হয়ে গেছে এখন কুরআনের দিন এসেছে।
৫- ইসরা ও মি‘রাজে নবীদের ইমামতির মাধ্যমে এ বিষয় প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত নবীর নবুওয়তের মাধ্যমে প্রাপ্ত শরী‘আত শেষ হয়েছে। এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত ও তারই শরীয়ত চলবে। আর তার শরীয়তই সর্বশেষ শরী‘আত। তিনিই শেষ নবী ও রাসুল।
৬- দুই কেবলার ইমামতি ও নেতৃত্ব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার উম্মতদের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। এ দু’টির মালিকানা তাদেরই।
৭- এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, দুনিয়ার মানুষ আপনাকে সম্মান করতে কমতি করলেও আকাশে যারা আছে তারা আপনাকে সবচেয়ে বেশী সম্মানিত করে গ্রহণ করে নিচ্ছে। দুনিয়াতে মানুষের কর্মকাণ্ডে আপনি দুঃখিত হলেও আকাশে আপনাকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য অনেকেই রয়েছেন। সর্বোপরি মহান আল্লাহ্ আপনাকে ছেড়ে যাবেন না।
৮- সালাত এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রুকন যার ফরয হওয়ার ঘোষণা কোন মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন। আর যা দুনিয়াতে ফরয না করে আকাশে প্রিয় নবীকে ডেকে এনে জানিয়ে দিয়েছেন। এটা যেন উম্মতের জন্য এক হাদীয়া। সে হাদীয়া যেন মাটিতে দেয়া যেত না, আকাশেই দিতে হবে।
৯- এর ফলে হিজরতের পথ প্রসারিত হলো, এর মাধ্যমে জানানো হলো যে, মূসা আলাইহিস সালামের উম্মতের চেয়েও তার উম্মত বেশী হবে। ফলে এর মাধ্যমে দাওয়াতের নতুন ক্ষেত্র আবিস্কৃত হবে এটাই বোঝা গেল।
১০- কারও রক্তচক্ষুর ভয় না করে হকের কথা বলতে সদা সচেষ্ট থাকা। যেমন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মে‘রাজের কথা সবাইকে জানিয়েছিলেন। সুতরাং বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাও এর লক্ষ্য ছিল।
১১- কারা ঈমানদার ও কারা বেঈমান বা দুর্বল ইমানের অধিকারী সেটা পরিস্কার হয়ে যাওয়া। মহান আল্লাহ বলেন,
 ﴿وَمَا جَعَلۡنَا ٱلرُّءۡيَا ٱلَّتِيٓ أَرَيۡنَٰكَ إِلَّا فِتۡنَةٗ لِّلنَّاسِ﴾ [سورة بني إسرائيل: 60]
অর্থাৎ “আর আমরা আপনাকে যে দৃশ্য দেখিয়েছিলাম, তা তো কেবল মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যই”। [সূরা আল-ইসরা: ৬০]
কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নতুন মিশনে যাচ্ছেন। সেখানে পাক্কা ইমানদারদের প্রয়োজন হবে।
১২- আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঈমানের দৃঢ়তা এখানে প্রকাশ পেল। তিনি নির্দ্বিধায় সেটার উপর ঈমান এনেছিলেন।
১৩- বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি কেমন হতে পারে সেটার এক নির্দেশনা পেলে মানুষের পক্ষে দ্বীন ও ঈমানের উপর মজবুতি আসবে।
১৪- দুধ পান করা ও মদ থেকে দুরে থাকার মাধ্যমে ইসলাম যে স্বাভাবিক দ্বীন সেটা প্রমানিত হলো।
১৫- মাসজিদুল আকসা সমস্ত মুসলিমের সম্পদ। যেখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাত আদায় করেছেন। ইমামতি করেছেন। আকাশে আরোহন করেছেন। সেখানে গেলে সওয়াব হওয়া কথা ঘোষণা করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বাইতুল মুকাদ্দাসের মুক্তির সাথেই মুসলিম উম্মাহর সম্মান ও প্রতিপত্তি নিহিত।
[sourse-http://www.tawheedullaah.com/isra_miraj/]

No comments:

Post a Comment